“কত দিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে…
জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে ”
জনপ্রিয় -এই গানটি কম-বেশি হয়ত আমরা সবাই শুনেছি বটে, কিন্তু এক মধ্যবয়সী নারীর জীবন চলার গান আমরা অনেকেই হয়ত শুনিনি।
শুক্লা রাণী দেব। বাড়ি নাছিরাবাদ। শ্যামগ্রাম ইউনিয়ন। নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। স্বামী মারা গেছেন প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি। একমাত্র সন্তানও মারা গেছেন স্বামী মৃত্যুর ক’বছর পর।
…এরপর আর বিয়ে-শাদী হয়নি। বিধবা মানুষ। আবার নিঃসন্তান। থাকেন ভাইদের সাথে। টানাপোড়েন সংসার তাঁদের। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা।
সংসারে বেগতিক দেখে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে নামেন কিছু একটা করে খাওয়ার। যা তা তো করা যায় না। চাই একটু সম্মানও। নামেন পত্রিকা বিক্রির পেশায়। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে বাড়ি-বাড়ি, দোকানে-দোকানে পত্রিকা বিক্রি করে যা পেয়েছেন, তাতে এতদিন চললেও এখন আর পারছেন না।
কারণ, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়েছে আবেগ। একদা মানুষ পত্রিকা পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকলেও, তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ইন্টারনেটে সব খবর হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় বলে- এখন আর আগের মতন কেউ পত্রিকা পড়েন না।
তাই পত্রিকা পাঠের আগ্রহ বা চাহিদা আগের মত আর নাই। নাই শুক্লা রাণীর জীবন-জীবীকা ও সেই আগের মত চলা।
হাতে গুনা বিশ/ত্রিশটা পত্রিকা প্রতিদিন আনলেও তার অধিকাংশই অবিক্রিত থাকে।
“স্যার, একটা পত্রিকা দেন, এই বেলা বেচা না অইলে সন্ধ্যা বেলায় ১০ টাকার পত্রিকা ১০ টাকা কেজি দরে বেচন লাগব। একটা পত্রিকা নেন স্যার। পত্রিকা বেচনের টাকা দিয়া অষুধ খামু।”
কথাটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি আব্বাস উদ্দীন হেলাল ভাই,
তিনি একটা ঔষধ কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার।
আলাপ পরিচয়ের এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন হালহকিকত। এক পর্যায়ে জিগ্যেস করলেন; লাভ না হইলে পত্রিকা বেচেন কেন?
বল্লেন; “কি আর করুম। আর তো কিছু জানি না। কত মাইনষের কাছে গেছি। কেউ একটা বয়স্ক ভাতা তো দূর, বিধবা ভাতাও করে দিল না। একটা ভাতা পাইলেও তো ভাত খাই আর না খাই দুইটা ওষুধ খাইতে পারতাম। এই ভাবে কি বাঁচন যায় স্যার।”
আঁচলে যখন চোখ মুছলেন আর কোন কথা বাড়ানি হেলাল ভাই।
কোন কথা বাড়ানোও যায় না আর! মনের অজান্তেই অজানা অচেনা এক অসহায় নারী ও এক মায়ের চোখে অশ্রুজল দেখে বহু বছর আগে হারানো নিজের জন্মদাত্রীর মুখায়ব মনে করে চোখের কোনে জমে আসা জল সংবরন করলেন।
অতঃপর একটা পত্রিকা নিলেন। আর নিলেন জীবন ও সময়ের কাছে নত হতে যাওয়া এক নারীর সাক্ষাতকার।
কোন সুহৃদ ব্যক্তি ওনার পাশে দাঁড়াবেন বলে আশা করে স্থানীয় সাংবাদিকদের তাঁকে নিয়ে লিখতে অনুরোধ জানান তিনি।